ঢাকা ০১:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিভক্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপিতে দ্বন্দ্ব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩৭:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৮
  • ২৮০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চট্টগ্রাম-২ আসনে চলছে ত্রিমুখী ভোটের রাজনীতি। ফটিকছড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও রয়েছে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। নানা কারণে সংসদীয় এ আসনটি বেশ আলোচিত। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির পর আসনটিতে ধানের শীষের প্রার্থী নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তরিকত ফেডারেশন চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি জোটগত মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে তৃতীয় বারের মতো এমপি হয়েছিলেন। তবে, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এ আসনে জাতীয় রাজনীতি থেকে স্থানীয় রাজনীতি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।

ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত। একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে ফটিকছড়ি সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ক্রমে তা কমে আসে। জামায়াতের আগের সেই সশস্ত্র অবস্থান নেই। কিন্তু বহুধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের একাধিক পক্ষ এখনও সক্রিয়। এখানে সাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গে ক্যাডারদের দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। তাদের এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটাররা আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিএনপির বিশাল সমর্থন সৃষ্টি হয় ফটিকছড়িতে। তাই আগামী নির্বাচনে এখানে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের লড়াই তুমুল হবে বলে ভোটারদের ধারণা। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ আসন থেকে মনোনয়ন পাবে, নাকি জোট থেকে এবারও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে প্রার্থী করা হবে তা নিয়েই বেশি আলোচনা।

এ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রত্যাশা করছেন নবীন-প্রবীণ মিলে অন্তত একডজন নেতা। দলীয় কোন্দল থাকায় আপাতত বেশ সুবিধায় আছেন জোটনেতা ও বর্তমান এমপি নজিবুল বশর। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নৌকার মনোনয়ন চাইবেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে যারা আলোচনায় রয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের কন্যা খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান এম তৌহিদুল আলম বাবু, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ফখরুল আনোয়ার, সদস্য আমেরিকা প্রবাসী মোহাম্মদ শাহজাহান এবং উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়ব।

ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যা এক ডজন হলেও বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী, কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সহসম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী, চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ও ড্যাব নেতা ডা. খুরশিদ জামিল, সাবেক  ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ্ বাহার চৌধুরী- এমনটাই জানালেন নেতাকর্মীরা। এছাড়াও মরহুম সালাহ্ উদ্দীন কাদের (সাকা) চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী, তাদের জ্যেষ্ঠ ছেলে কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী মনোনয়ন চাইবেন বলেও লোকমুখে শোনা যাচ্ছে।

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যের দল তরিকত ফেডারেশনের সাংগঠনিক অবস্থান চোখে পড়ার মতো নয়। তবুও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান  সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী জোটের হয়ে নৌকা প্রতীকে লড়তে চান। এ প্রসঙ্গে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ফটিকছড়িতে আমি যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। যা আমাদের নেত্রী অবগত। আশা করি, নেত্রী এবারও আমাকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেবেন। এবারও আমি জয়লাভ করব। তবে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নন দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করা ত্যাগী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের দেশব্যাপী ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া; দলীয় এমপি না থাকায় ফটিকছড়িবাসী বঞ্চিত হয়েছে। একই সঙ্গে দলীয় পছন্দ অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়নি। তাদের এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগও। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরি বলেন, ফটিকছড়ির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বর্তমান এমপি উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে কোনো প্রকার পরামর্শ কিংবা সমন্বয় করেন না। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হলে আমরা উন্নয়ন কিংবা সুখ-দুঃখের সবকিছুতে এমপির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারতাম। আশা করি, আগামীতে নেত্রী আমাদের এ আসনে জোটের নয়, দলীয় ত্যাগী নেতাকে মনোনয়ন দিয়ে সংসদে ফটিকছড়ির প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেবেন।

এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। কিন্তু পরবর্তী সময় তার সঙ্গে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রী মোশাররফ আমাদের নেতা। আমরা অতীতের দূরত্ব কমিয়ে এনেছি। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী জানান, ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ফটিকছড়ির মানুষ তাকে এমপি নির্বাচিত করেছিলেন। আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান এম তৌহিদুল আলম বাবু বলেন, তিনি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে মানুষের নৈকট্যেও রয়েছেন তিনি। নিশ্চয়ই দল তাকে মূল্যায়ন করবে। আওয়ামী লীগ থেকে আরও মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের কন্যা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। রফিকুল আনোয়ার এ আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জয়ী হয়েছিলেন। এলাকায় তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। ১৯৯১ সালে ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী জয়ী হন। ২০০১ সালে তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক রফিকুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি জয়ী হন। এরপর  সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে নজিবুল বশর পরাজিত হন। এরপর তিনি তরিকত ফেডারেশন গঠন করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধেন।

অপরদিকে ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও এখন মাঠে। এ আসন বিএনপির নীরব ভোট ব্যাংক বলে জনশ্রুতি থাকলেও ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপিতেও রয়েছে দ্বন্দ্ব। এখানে দুটি পক্ষ সক্রিয়, একটি পক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া বিএনপির প্রয়াত নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পরিবারের অনুসারী। আরেকটি পক্ষ সাকা পরিবারের বিরোধী। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। যা অতীতের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ভয় মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নিয়ে।

ধানের শীষের প্রার্থী হতে এলাকায় যোগাযোগ বাড়িয়েছেন সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজীও। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চূড়ান্ত থাকলেও তিনি দলের চেয়ারপারসনের নির্দেশে ছাড় দিয়েছিলেন। এবার নিশ্চয়ই খালেদা জিয়া তার ওই ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন। মনোনয়ন প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ফটিকছড়িতে যোগ্য নেতার সংকট অনেক দিনের। এজন্যই এখানকার মানুষ শিক্ষায়, চিকিৎসায় ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও আন্দোলন-সংগ্রামে ফটিকছড়িবাসীর সঙ্গে থাকা নেতাকেই মূল্যায়ন করবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি আস্থা রাখলে এ আসনে নির্বাচিত হতে পারবেন বলে মনে করছেন কাদের গণি চৌধুরী।

ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) চমেক কলেজ শাখার সভাপতি এবং বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় তৎপরতা চালাচ্ছেন ডা. খুরশিদ। তিনি বলেন, ফটিকছড়ি একটি অবহেলিত জনপদ। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিএনপি এখানে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। দল থেকে যদি এ আসনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তবে তিনি জয়ী হয়ে ফটিকছড়িবাসীর কল্যাণে কাজ করবেন। সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী ওই আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। এ জন্য খালেদা জিয়ার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন তারা। উল্লেখ্য,৭৭৩ বর্গকিলোমিটারের ফটিকছড়ি উপজেলা দুটি থানা, দুটি পৌরসভা, ১৮টি ইউনিয়ন, ১০২টি মৌজা এবং ১৯৯টি গ্রাম নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি সংসদীয় আসন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

বিভক্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপিতে দ্বন্দ্ব

আপডেট টাইম : ১২:৩৭:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চট্টগ্রাম-২ আসনে চলছে ত্রিমুখী ভোটের রাজনীতি। ফটিকছড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও রয়েছে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। নানা কারণে সংসদীয় এ আসনটি বেশ আলোচিত। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির পর আসনটিতে ধানের শীষের প্রার্থী নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তরিকত ফেডারেশন চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি জোটগত মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে তৃতীয় বারের মতো এমপি হয়েছিলেন। তবে, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এ আসনে জাতীয় রাজনীতি থেকে স্থানীয় রাজনীতি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।

ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত। একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে ফটিকছড়ি সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ক্রমে তা কমে আসে। জামায়াতের আগের সেই সশস্ত্র অবস্থান নেই। কিন্তু বহুধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের একাধিক পক্ষ এখনও সক্রিয়। এখানে সাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গে ক্যাডারদের দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। তাদের এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটাররা আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিএনপির বিশাল সমর্থন সৃষ্টি হয় ফটিকছড়িতে। তাই আগামী নির্বাচনে এখানে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের লড়াই তুমুল হবে বলে ভোটারদের ধারণা। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ আসন থেকে মনোনয়ন পাবে, নাকি জোট থেকে এবারও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে প্রার্থী করা হবে তা নিয়েই বেশি আলোচনা।

এ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রত্যাশা করছেন নবীন-প্রবীণ মিলে অন্তত একডজন নেতা। দলীয় কোন্দল থাকায় আপাতত বেশ সুবিধায় আছেন জোটনেতা ও বর্তমান এমপি নজিবুল বশর। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নৌকার মনোনয়ন চাইবেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে যারা আলোচনায় রয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের কন্যা খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান এম তৌহিদুল আলম বাবু, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ফখরুল আনোয়ার, সদস্য আমেরিকা প্রবাসী মোহাম্মদ শাহজাহান এবং উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়ব।

ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যা এক ডজন হলেও বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী, কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সহসম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী, চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ও ড্যাব নেতা ডা. খুরশিদ জামিল, সাবেক  ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ্ বাহার চৌধুরী- এমনটাই জানালেন নেতাকর্মীরা। এছাড়াও মরহুম সালাহ্ উদ্দীন কাদের (সাকা) চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী, তাদের জ্যেষ্ঠ ছেলে কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী মনোনয়ন চাইবেন বলেও লোকমুখে শোনা যাচ্ছে।

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যের দল তরিকত ফেডারেশনের সাংগঠনিক অবস্থান চোখে পড়ার মতো নয়। তবুও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান  সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী জোটের হয়ে নৌকা প্রতীকে লড়তে চান। এ প্রসঙ্গে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ফটিকছড়িতে আমি যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। যা আমাদের নেত্রী অবগত। আশা করি, নেত্রী এবারও আমাকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেবেন। এবারও আমি জয়লাভ করব। তবে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নন দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করা ত্যাগী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের দেশব্যাপী ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া; দলীয় এমপি না থাকায় ফটিকছড়িবাসী বঞ্চিত হয়েছে। একই সঙ্গে দলীয় পছন্দ অনুযায়ী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়নি। তাদের এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগও। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরি বলেন, ফটিকছড়ির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বর্তমান এমপি উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে কোনো প্রকার পরামর্শ কিংবা সমন্বয় করেন না। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হলে আমরা উন্নয়ন কিংবা সুখ-দুঃখের সবকিছুতে এমপির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারতাম। আশা করি, আগামীতে নেত্রী আমাদের এ আসনে জোটের নয়, দলীয় ত্যাগী নেতাকে মনোনয়ন দিয়ে সংসদে ফটিকছড়ির প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেবেন।

এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। কিন্তু পরবর্তী সময় তার সঙ্গে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রী মোশাররফ আমাদের নেতা। আমরা অতীতের দূরত্ব কমিয়ে এনেছি। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী জানান, ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ফটিকছড়ির মানুষ তাকে এমপি নির্বাচিত করেছিলেন। আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান এম তৌহিদুল আলম বাবু বলেন, তিনি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে মানুষের নৈকট্যেও রয়েছেন তিনি। নিশ্চয়ই দল তাকে মূল্যায়ন করবে। আওয়ামী লীগ থেকে আরও মনোনয়ন চাইতে পারেন সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের কন্যা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। রফিকুল আনোয়ার এ আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জয়ী হয়েছিলেন। এলাকায় তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। ১৯৯১ সালে ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী জয়ী হন। ২০০১ সালে তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক রফিকুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি জয়ী হন। এরপর  সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে নজিবুল বশর পরাজিত হন। এরপর তিনি তরিকত ফেডারেশন গঠন করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধেন।

অপরদিকে ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও এখন মাঠে। এ আসন বিএনপির নীরব ভোট ব্যাংক বলে জনশ্রুতি থাকলেও ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপিতেও রয়েছে দ্বন্দ্ব। এখানে দুটি পক্ষ সক্রিয়, একটি পক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া বিএনপির প্রয়াত নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পরিবারের অনুসারী। আরেকটি পক্ষ সাকা পরিবারের বিরোধী। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে। তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। যা অতীতের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ভয় মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নিয়ে।

ধানের শীষের প্রার্থী হতে এলাকায় যোগাযোগ বাড়িয়েছেন সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজীও। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চূড়ান্ত থাকলেও তিনি দলের চেয়ারপারসনের নির্দেশে ছাড় দিয়েছিলেন। এবার নিশ্চয়ই খালেদা জিয়া তার ওই ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন। মনোনয়ন প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ফটিকছড়িতে যোগ্য নেতার সংকট অনেক দিনের। এজন্যই এখানকার মানুষ শিক্ষায়, চিকিৎসায় ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও আন্দোলন-সংগ্রামে ফটিকছড়িবাসীর সঙ্গে থাকা নেতাকেই মূল্যায়ন করবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি আস্থা রাখলে এ আসনে নির্বাচিত হতে পারবেন বলে মনে করছেন কাদের গণি চৌধুরী।

ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) চমেক কলেজ শাখার সভাপতি এবং বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় তৎপরতা চালাচ্ছেন ডা. খুরশিদ। তিনি বলেন, ফটিকছড়ি একটি অবহেলিত জনপদ। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিএনপি এখানে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। দল থেকে যদি এ আসনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তবে তিনি জয়ী হয়ে ফটিকছড়িবাসীর কল্যাণে কাজ করবেন। সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী ওই আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। এ জন্য খালেদা জিয়ার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন তারা। উল্লেখ্য,৭৭৩ বর্গকিলোমিটারের ফটিকছড়ি উপজেলা দুটি থানা, দুটি পৌরসভা, ১৮টি ইউনিয়ন, ১০২টি মৌজা এবং ১৯৯টি গ্রাম নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি সংসদীয় আসন।